NFT- কি? কিভাবে কাজ করে NFT বিস্তারিত | Non-Fungible Token (NFT)
প্রযুক্তি আমাদেরকে প্রতিনিয়তই কিছু-না-কিছু দিয়ে যাচ্ছে। এর কল্যাণে আমরা প্রতিদিন নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন করছি। এর সাথে আমাদের চিন্তাধারা আচার-আচরণ চাহিদা সবকিছুই পরিবর্তন ঘটছে। বর্তমান সময় অনলাইন জগতে এন এফ টি NFT একটি হট টপিক জানিয়ে প্রচুর পরিমাণে লেখা হচ্ছে। দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহারকৃত অনেক কিছুই NFT তে সামনের দিকে যুক্ত হবে বলে ধারণা করা যায়।
NFT – Non Fungible Token হল একটি মৌলিক জিনিস যার একটি নির্দিষ্ট পরিমান মূল্য আছে | টোকন শব্দ টির সাথে আমরা অনেকেই পরিচিত | যেমন ইউনিভার্সিটির হলে খেতে গেলে টাকা দিয়ে টোকেন কিনতে হয় তারপর সে টোকেন দিয়ে খাওয়া নিতে হয় অর্থাৎ টোকেন ছাড়া খাবার নেয়া যাবে না | আবার কোন জায়গায় গাড়ি পার্ক করার পর টোকেন দেওয়া হয় তারপর গাড়ি নেওয়ার সময় সে টোকেন দিয়ে গাড়ি নিতে হয় | মাল ও মালিকানা প্রমাণের জন্য টোকেন এর প্রয়োজন।
NFT কি এবং কিভাবে এটি কাজ করে
Non-Fungible Token সংক্ষেপে NFT হলো ইউনিক বস্তু বা ডিজিটাল আইডিয়া বেচাকেনা করার একটি টোকেন। Bitcoin বা cryptocurrency সম্পর্কে আমরা অনেক কিছুই শুনেছি। ডিজিটাল মুদ্রা হিসেবে এটি সারা বিশ্বেই সাড়া ফেলেছে। এরই মধ্যে গত বছর এনএফটি নিয়ে এলো সম্পূর্ণ নতুন এক ধারনা। আজকে আমরা এই সম্পর্কেই জানার চেষ্টা করব।
NFT কি?
Non-Fungible Tokens (NFT) হল ডিজিটাল সম্পদ যেমন গেম, আর্ট এবং ভার্চুয়াল এসেট যা ব্লকচেইন প্ল্যাটফর্ম যেমন Ethereum, OpenSea, Rarible, Axie Marketplace এর মাধ্যমে বিনিময় করা হয় । অন্যভাবে NFT হল বিনিময়যোগ্য ডিজিটাল সম্পদ যা ইন্টারনেটের মাধ্যমে ব্যবসা করা হয়। এনএফটি নির্মাতাদের জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়ছে। ব্যবসায়ী,সেলিব্রিটিরা এখন তাদের ব্র্যান্ডকে অধিক বাণিজ্যিকীকরণ লক্ষ্যে এনএফটি ক্রয় এবং বিক্রি করে। এনএফটি ক্রিপ্টোকারেন্সিতে তৈরি এবং লেনদেন করা হয়। NFT তৈরি করতে হলে একটি ডিজিটাল সম্পদ থেকে একটি NFT মিন্ট করতে হবে। জনপ্রিয় NFT-এর মধ্যে রয়েছে ডিজিটাল কাজ, ভিডিও এবং ডিজিটালাইজ করা যেতে পারে এমন কিছু।
Fungible শব্দটির বাংলায় আভিধানিক অর্থ ছত্রাকের সংক্রমনযোগ্য। তাহলে Non-Fungible অর্থ দাঁড়ায় যা ছত্রাক দ্বারা সংক্রমিত হয় না। কিন্তু NFT র সাথে ছত্রাকের কোনো সম্পর্ক নেই। এখানে Fungible দ্বারা বুঝানো হয় যা অদল বদল করা যায় কিংবা সমতুল্য কিছু দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়। একটু বিশ্লেষন করে বললে আপনাদের বুঝতে সুবিধা হবে। ধরুন আপনি চা দোকানে হালকা চা পান খেতে গেলেন কিন্তু আপনার কাছে খুচরা টাকা নেই, ৫০০টাকার একটি নোট আছে । তো আপনি আসলে আগে চেষ্টা করবেন যে ৫০০টাকা ভাঙতি করে ৫টা ১০০টাকার নোট নিতে । এখন আপনি ৫টি ১০০ টাকার নোট নেয়ার পরেও কি আপনার টাকার পরিমানে কোনো হেরফের হয়েছে? না হয়নি। আগে যে পরিমান টাকা ছিল এখনও সে পরিমানই আছে শুধু একটা নোট পাঁচটা নোট হয়েছে। এই বিষয়টিকে বলা হয় Fungible. পক্ষান্তরে Non-Fungible এর মানে হলো যে বিষয় বা বস্তু অন্য কিছু দিয়ে বদলানো যায় না। এই বিষয়টিকেও একটি উদাহরন দিয়ে বুঝালে বুঝতে সুবিধা হয়, যেমন আমাদের প্রিয় কবি কাজী নজরুলের একটি উপন্যাস শিউলি-মালা। এই উপন্যাসের বহু অনুলিপি আপনি বাজারে পাবেন কিন্তু আপনি যদি কোনোভাবে কবির নিজ হাতে লেখা মূল বইটি পেয়ে যান তাহলে আপনি কি সেটি কোনোভাবে ছাড়তে চাইবেন? অবশ্যই চাইবেন না। আবার কবির নিজ হাতে লেখা এই উপন্যাসটির দ্বিতীয়টি কি পাওয়া যাবে কোথাও? না পাওয়া যাবে না। তাহলে এই উপন্যাসটিকে বলা যাবে Non-Fungible. আবার ধরুন আমাদের ক্রিকেটের অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান যদি তাঁর জীবনের শেষ ম্যাচটিতে খেলা ব্যাটটি আপনাকে দিয়ে দেয়, তাহলে এই ব্যাটটির সমতুল্য কি আর কোনো ব্যাট হবে? না হবে না । কারন এটি একটি-ই ব্যাট যা দিয়ে সাকিব তাঁর শেষ ম্যাচটি খেলেছেন। তো এই জিনিসগুলোই আসলে Non-Fungible. এবার টোকেন নিয়ে একটু বলি, টোকেন আসলে কি? টোকেন হলো প্রমান বা নিদর্শন, নিশ্চয়তা বা স্বীকারপত্র। পাব্লিক প্লেসে বেড়াতে গেলে যখন গাড়ী পার্কিং করার প্রয়োজন হয়, তখন অনেক গাড়ী সেখানে থাকে। কর্তৃপক্ষ আপনার গাড়িকে নির্দিষ্ট করে বুঝানোর জন্যে আপনাকে একটি কাগজ দিবে যা পরে দেখালে আপনার গাড়ি আপনাকে হস্তান্তর করবে কিন্তু দেখাতে না পারলে আপনাকে জটিলতায় পড়তে হবে। এখানে প্রমাণস্বরূপ কাগজটিই আসলে টোকেন। এনএফটি হলো এমন ধরনের প্রমানপত্র যা দ্বারা কোনো কিছুর মালিকানা নিশ্চিত হয়।
NFT র ইতিহাস
গত দশকের প্রথম দিক থেকেই ডিজিটাল মুদ্রার প্রচলন শুরু হয়েছে এবং তা ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। NFT ধারনা প্রথম ২০১৪ সালে কেভিন ম্যাককয় এবং অনিল দাশ নামে দুজন ব্যাক্তির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয় যেখানে কেভিন ম্যাককয়ের স্ত্রীর তৈরি একটি নন ফাঞ্জেবল ভিডিও ব্লক চেইনের মাধ্যমে বিক্রি হয়। এরপর থেকে ২০১৭ পর্যন্ত খুবই ধীর গতিতে এগিয়েছে। ২০১৭ সালে অনলাইন গেম CryptoKitties NFT প্রযুক্তিতে বিক্রি হয় সফলতার সাথে। এরপর থেকেই এটি আস্তে আস্তে জনপ্রিয় হওয়া শুরু করেছে। ২০২০ সালে NFT বাজার দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২১ সালের প্রথম তিন মাসে NFT তে প্রায় ২০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি লেনদেন হয়েছে।
NFT তে যা যা বেচাকেনা করা যায়
এনএফটি তে যেকোনো জিনিস বিক্রয়ের শর্ত হলো মৌলিক বা অনন্য হওয়া। মূলত গেইম, ডিজিটাল আর্ট, প্রবন্ধ, রিসার্চ পেপার এগুলো এনএফটি তে বিক্রয় হয়।
ডিজিটাল আর্ট
আপনার নিজের তৈরি যেকোনো চিত্র, গান, ফিল্ম বিক্রি করতে পারবেন যদি সেটির আর কোনো নকল কারো কাছে না থাকে। NFT র মাধ্যমে আপনি মালিকানার স্বত্তাধিকারী হবেন এবং ছড়া মূল্যে আপনার তৈরি যেকোনো আর্ট বিক্রি করতে পারবেন। এই প্রযুক্তি ডিজিটাল দুনিয়ায় আপনাকে পরিচিত করে তুলবে সহজে। bipol নামের একজন শিল্পী তার ছবিগুলোর একটি পোর্টফোলিও বিক্রি করেছে ৬৯ মিলিয়ন ডলারে।
কালেক্টিভস
আপনার যেকোনো সংগ্রহ যেটি আর কারও কাছে নেই যেমন প্রাচীন মুদ্রা, খেলোয়াড়ের জার্সি ইত্যাদি। এসব কিছুও NFT তে বিক্রয় হয়।
অনলাইন গেইম
আপনার নিজের পরিকল্পনায় তৈরি গেইম যেটি সম্পূর্ণ নতুন আবিষ্কার বা এই ধরনের গেইম আগে থেকে নেই এমন ধরনের গেইম NFT তে বিক্রি হয়।
রিসার্চপেপার
রিসার্চ পেপার হলো ব্যক্তির নিজ পর্যবেক্ষনের লিখিত রূপ। এটি সম্পূর্ণ ইউনিক একটি বিষয়। কারন ব্যক্তি নিজ ধ্যান ধারনা থেকে এসব মূল্যয়ন করেন তা আর কারও সাথে পুরোপুরি মিলে যাওয়া সম্ভব না। টুইটারের সিইও জ্যাক ডরসি তাঁর করা প্রথম টুইট NFT তে বিক্রি করেন ২.৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে।
ভবিষ্যতে NFT র প্রভাব
এখন পর্যন্ত NFT বেশিরভাগ দেশে চালু হয় নি। এছাড়া নিজ দেশের জ্ঞানীদের মেধাস্বত্ত্ব, মূল্যবান ও ঐতিহ্যের অংশ প্রাচীন বিভিন্ন জিনিস এক দেশ থেকে অন্য দেশে চলে যাওয়ার ভয়ে বিভিন্ন দেশ এখনও NFT অনুমোদন করেনি। এই প্রযুক্তি আরও বিস্তৃত হবে যখন ব্লকচেইন সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়বে। তবে বিশেষ ব্যক্তিবৃন্দ যেমন অনেক সেলিব্রেটি, ব্যবসায়ী, প্রযুক্তিবিদ, খেলোয়াড় ইতিমধ্যে NFT তে যুক্ত হয়েছেন।
পরিশেষে আশা করা যায়, এই প্রযুক্তি ই কমার্স ও আন্তর্জাতিক ক্রয় বিক্রয়ে স্বচ্চতা আনবে। যেকোনো ব্যক্তি নিজ প্রতিভার সঠিক মূল্য পাবে।