প্রতিবেদন লেখার নিয়ম ও উদাহরণ শিখুন ২০২২

আমরা দৈনন্দিন জীবনে প্রতিনিয়ত খবরের কাগজে বা কোনো ম্যাগাজিনে কোনো বিষয়ে প্রতিবেদন পড়ে থাকি। কিন্ত আদতে প্রতিবেদন সম্পর্কে বা প্রতিবেদন কি তা আমাদের অনেকের জানা নেই বা বিষয়টি সম্পর্কে জানার জন্য তেমন গুরুত্ব দেয়না। ছাত্র ছাত্রীদের জন্যে এসব নিয়ম খুবই প্রয়োজনীয়। শুধু ছাত্রজীবনই নয় কর্ম জীবনেও প্রতিবেদন লেখার প্রয়োজন পড়ে। তাহলে এবার জানা যাক প্রতিবেদন কী-
“নির্দিষ্ট কোনো বিষয়কে কেন্দ্র করে সেই বিষয়ে পাঠকের বোধগম্য বা পাঠের উপযোগী করে নিজের লেখাকে উপস্থাপন করায় হলো প্রতিবেদন” । ইংরেজিতে এটিকে Report বলা হয়।
বাংলা প্রতিবেদন লিখার সময় পাঠকের বুঝার সুবিধাটি মাথায় রাখতে হবে। অর্থাৎ প্রতিবেদনটি এমন হবে যাতে প্রতিটি বাক্য সহজ, সাবলীল,অর্থপূর্ণ এবং সুস্পষ্ঠ হয়। একটি প্রতিবেদনকে পাঠকের সামনে যথাযথ গুরুতার সহিত উপস্থাপন করা প্রতিবেদকের আবশ্যকীয় দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। প্রতিবেদনকে পাঠকের সামনে সুন্দর,মার্জিত এবং পাঠকের বুঝার সুবিধার্থে অর্থাৎ পাঠকের বোধগম্য হওয়ার কিছু নিয়ম রয়েছে। প্রতিবেদন লেখার নিয়ম বা রিপোর্ট লেখার নিয়ম গুলো ধাপে ধাপে আপনাদের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করব।
প্রথমত জেনে নেওয়া যাক প্রতিবেদনের শ্রেনিবিভাগ
প্রতিবেদন লিখা হয় বিভিন্ন বিষয়ের উপর ভিত্তি করে। এই বিষয়গুলোকে কেন্দ্র করে প্রতিবেদনের শ্রেনিবিভাগে করা হয়েছে। প্রতিবেদনের এই শ্রেনিবিভাগ গুলো নিচে উল্লেখ করা হলোঃ
➤প্রযুক্তি বিষয়ক প্রতিবেদন।
➤ক্রীড়ামূলক প্রতিবেদন।
➤তদন্ত বিষয়ক প্রতিবেদন।
➤দুর্ঘটনাজনিত প্রতিবেদন।
➤চারপাশের পরিবেশ বিষয়ক প্রতিবেদন।
➤সমাজনীতি ও রাজনীতি বিষয়ক প্রতিবেদন।
➤বিশেষ দিন সম্পর্কে প্রতিবেদন।
➤অর্থনীতি বিষয়ক প্রতিবেদন।
➤আন্তর্জাতিক বিষয়ে প্রতিনেদন।
➤সম্পাদকীয় বিষয়ক প্রতিবেদন।
জীবনে চলার পথে আমাদের প্রত্যেকের কিছু বাঁধা বিপত্তি ঝড় ঝাপটার সম্মুখীন হতে হয় । এই যে সমস্যা গুলো আমরা কোনো না কোনোভাবে মানুষের সম্মুখে উপস্থাপন করতে চাই । জনসমাজ এই সমস্যাগুলো সম্পর্কে জানার পাশাপাশি সমস্যাসমূহ সম্পর্কে সচেতন হতে পারবে। জনসম্মুখে সমস্যাগুলো যেমনি তুলে ধরতে পারি তেমনি সমস্যা থেকে উত্তরণের পথ খুঁজে পেতে পারি।
প্রতিবেদন হলো সমস্যা তুলে ধরার বা সমস্যা থেকে উত্তরণের একটি মাধ্যম বলা যায়। যেমন
সমস্যা বা সমাধান কোনো একটি বিষয়কে কেন্দ্র করে হয় তেমন প্রতিবেদনও লিখতে হয় কোনো একটি বিষয়কে কেন্দ্র করে। তাই প্রতিবেদনের বিষয়বস্তু লিখতে হলে কিছু তথ্যাদি জানতে হয় –
প্রতিবেদন লিখার ক্ষেত্রে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মেনে চলতে হবে
১.প্রতিবেদনটি হতে হবে সংক্ষিপ্ততার সহিত অর্থপূর্ণ।
২.প্রতিবেদনটি হতে হবে সহজ, সাবলীল এবং সুস্পষ্ট।
৩.প্রতিবেদনের সহিত আবশ্যকীয় শিরোনাম থাকতে হবে।
৪.প্রতিবেদনের ও শিরোনামের বিষয়বস্তর মিল থাকতে হবে।
৫.প্রতিবেদনের বিষয়বস্তু যাতে সমসাময়িক বা বর্তমান বা চলমান কোনো ঘটনা বা বিষয়ে হয় সেদিকে দৃষ্টিপাত করতে হবে।
এখন তো জেনে নিলাম কী কী বিষয় মেনে প্রতিবেদন(protibedon lekhar niyom) লিখতে হয়। চলুন তাহলে এখন জেনে নেওয়া যাক কিভাবে প্রতিবেদনের গঠন সম্পর্কে।
প্রতিবেদনের প্রয়োজনীয়তা
কোনো একটি বিষয়বস্তু বা ঘটনাপ্রবাহ যথাযথ কর্তৃপক্ষের নিকট সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরার জন্যে প্রতিবেদনের গুরুত্ব অনেক। আইন-আদালত, প্রশাসন, অপরাধ তদন্ত বিভাগ, ব্যবসা বানিজ্য সব জায়গাতেই প্রতিবেদন বা রিপোর্ট করার প্রয়োজন হয়। আগে শুধু পত্রিকায় প্রকাশিত বিভিন্ন লেখাগুলোকেই প্রতিবেদন বলা হতো। কিন্তু এখন গনমাধ্যমের অনলাইন অফলাইন অনেক শাখা তৈরি হয়েছে । তাই প্রতিবেদনের প্রকাশের অনেক ক্ষেত্র তৈরি হওয়ায় অনেক অনেক প্রতিবেদনেরও প্রয়োজন পড়ছে এখন। প্রতিবেদনের মাধ্যমে কোনো বিষয় কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়। যাতে ঘটনাপূর্ব কিংবা পরবর্তীতে ব্যবস্থা গ্রহন করা যায়।
প্রতিবেদনের গঠন
প্রতিবেদন মূলত কিছু প্রধান স্ট্রাকচার নিয়ে গঠিত হয়। প্রতিবেদন লিখতে গেলে এই স্ট্রাকচারটি ঠিক রাখতে হয়। একটি প্রতিবেদন লিখতে ৪টি গাঠনিক বিষয় লাগে অর্থাৎ ৪টি বিষয় নিয়ে প্রতিবেদন গঠিত হয়। যেমনঃ
১.শিরোনাম।
২.প্রতিবেদকের নাম।
৩.স্থান।
৪.তারিখ।
বিস্তারিতভাবে জানা যাক প্রতিবেদনের গঠনপ্রনালী সম্পর্কে।
১.শিরোনাম
শিরোনাম হলো প্রতিবেদনের প্রথম,প্রধান এবং গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই শিরোনামই পাঠককে নির্ধারণ করে দেয় যে পাঠক প্রতিবেদনটি পড়বে কি পড়বেনা। অর্থাৎ শিরোনাম যাতে পাঠকের মনকে আকৃষ্ট করে। সেই জন্য শিরোনাম সহজ ও সুন্দর হতে হবে। মনে রাখা জরুরি যে পাঠকের মন আকৃষ্ট হতে হলে শিরোনাম আকর্ষনীয় হতে হবে। পাঠক এতে প্রতিবেদন পড়তে আগ্রহী হবে।
২.প্রতিবেদকের নাম
প্রতিবেদনে(protibedon writing in bengali) প্রতিবেদকের নাম লিখাটা আলাদা গুরুত্ব ও তাৎপর্য বহন করে। প্রতিবেদনে প্রতিবেদকের নাম লিখার একটা নিয়ম আছে এর মাধ্যমে প্রতিবেদনটি কে লিখলো বা কার অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তা জানা যায়।
৩.স্থান
প্রতিবেদনটি কোন স্থানের সমস্যা বা ঘটনা হচ্ছে বা ঘটছে তা বুঝাতে সেই স্থানের নাম উল্লেখ করতে হবে। প্রতিবেদনে স্থানের নাম উল্লেখ করাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
৪.তারিখ
প্রতিবেদনের শুরুতে তারিখ উল্লেখ করাটা অতীব গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় অংশ।
প্রতিবেদন রচনায় কিছু লক্ষনীয় বিষয়
সঠিক তথ্য
প্রতিবেদন রচিত-ই হয় কোনো নির্দিষ্ট ঘটনাকে কেন্দ্র করে । ধারনার উপর ভিত্তি করে রসালো গল্প তৈরি করা গেলেও প্রতিবেদনে তা যায় না। প্রতিবেদন সম্পূর্ণ নির্ভুল ও তথ্যগত দিক থেকে সঠিক হতেই হবে।
অতিরিক্ত বর্ণনা না দেয়া
একটি প্রতিবেদন (protibadon) পড়তে গেলে যাতে পাঠকের মনে হয় তিনি মূল বিষয়ের দিকে যাচ্ছেন কোনো ভাবেই যাতে এমন না হয় যে অতিরিক্ত বর্ণনার কারনে মূল বিষয় থেকে ফোকাস সরে যাচ্ছে। ছোট খাটো বিষয় দিয়ে প্রতিবেদন বড় করা যাবে না। এতে পাঠক বিরক্ত হয়ে আপনার প্রতিবেদন পড়া বাদ দিয়ে দিতে পারে।
আকর্ষনীয় উপস্থাপনা
আপনার প্রতিবেদন একবার পড়ে যেন পাঠকের প্রতিবেদকের প্রতিটি প্রতিবেদনের প্রতি আকর্ষন তৈরি হয় এমনভাবে উপস্থাপন করতে হবে।
পক্ষপাতিত্ব করা যাবেনা
প্রতিবেদককে কোনোভাবেই একটি পক্ষের অনুকুলে সাফাই গাওয়ার মত করে প্রতিবেদন লেখা যাবে না। অবশ্যই অতি উতসাহী হয়ে কিংবা আবেগী হয়েও প্রতিবেদন লেখা যাবে না। স্ট্রং সোর্স থেকে তথ্য অনুসন্ধান করতে হবে।
ফলো-আপ প্রতিবেদন তৈরি করা
প্রতিবেদনে অতি কথা পরিহার করতে হবে এতে এটি প্রাঞ্জল ও ওজনী হয়। আর প্রতিবেদককে অবশ্যই ঘটনার আপডেট দিয়ে ফলো আপ প্রতিবেদন তৈরি করতে হবে । এতে পাঠক সেসব সংবাদ মাধ্যমের প্রতি আস্থা পায়।
ভাষার সঠিক প্রয়োগ
প্রতিবেদনে সাধু চলিত ভাষা মিশ্রন ঘটিয়ে গুরুচন্ডালী করা যাবে না। এতে ভাষার সঠিক প্রয়োগ থাকা আবশ্যক।
সবার বুঝার সুবিধার্থে প্রতিবেদনের নমুনা তুলে ধরা হলো-
বরাবর
অধ্যক্ষ
হলিক্রস কলেজ
তেজগাঁও,ঢাকা।
বিষয়ঃ কলেজ কর্তৃক আয়োজিত অমর একুশে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠানমালা সম্পর্কে প্রতিবেদন।
সূত্রঃঢা.ধা.ক.ম.ক/২৭(ক)/২০২২
জনাব,
সম্প্রতি সমাপ্ত হওয়া হলিক্রস কলেজের ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠানমালা সম্পর্কে প্রতিবেদনের পাশে আদিষ্ট হয়ে নিম্নে প্রতিবেদন উপস্থাপন করছি।
হলিক্রস কলেজে অনুষ্ঠান উদযাপন
১. অমর একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপন উপলক্ষে ২১ ফেব্রুয়ারি দিনব্যাপী আয়োজিত অনুষ্ঠান পরিচালনায় ছিল হলিক্রস কলেজের ছাত্র ছাত্রী সংসদ।
২. সকাল ৭ঃ০০টায় অনুষ্ঠানমালার সূচনা হয় প্রভাতফেরীর মাধ্যমে। প্রভাতফেরীতে যোগদান করেন ছাত্র, ছাত্রী,শিক্ষকবৃন্দ এবং কলেজ কর্তৃপক্ষ সহ। সেই সময় নগ্ন পায়ে হেটে সবার কন্ঠে বেজে উঠে
“আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি “
৩. সকলে শহীদ মিনারের পাদদেশে এসে উপস্থিত হয়। কলেজের সকলে মিলে পুষ্পার্পন করে শহীদদের শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
৪. অমর একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে শিক্ষার্থীদের মধ্যে দেশাত্মবোধক গান,কবিতা আবৃত্তি এবং অঙ্কন প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়।
৫. গণমাধ্যম কর্মীদের সাথে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়।
৬. সবশেষে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহনকারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে পুরষ্কার বিতরণ এবং আয়োজিত মিলাদ মাহফিলের মাধ্যমে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘটে।
৭. মহান ২১শে ফেব্রুয়ারির যে গুরুত্ব ও তাৎপর্য তা এই প্রজন্মের চেতনা ও প্রেরনার উৎস হয়ে ফুটে ওঠে।
প্রতিবেদকের নামঃ তানবীন জারা
প্রতিবেদনের শিরোনামঃহলিক্রস কলেজে অমর একুশে ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠান উদযাপন।
প্রতিবেদনের সময়ঃ ০৭.০৪.২০২২।
পরিশেষে
প্রতিবেদন যেমন কোনো একটি ঘটনা সম্পর্কে বিস্তারিত বলে তেমনি কোনো একটি সমস্যা সম্পর্কে বলে সাথে সমস্যা সমাধানের পথও বাতলে দেয়।
আশা করা যায় উল্লেখিত প্রতিবেদন থেকে আমরা যা শিখলাম তা আমাদের প্রতিবেদন লিখতে সাহায্য করবে।