গ্রাফিক ডিজাইন কি? গ্রাফিক ডিজাইনে ক্যারিয়ারের ভবিষ্যত

আপনি যদি জানতে চান যে গ্রাফিক ডিজাইন কি? কিভাবে গ্রাফিক ডিজাইন শিখা যায় এবং কিভাবে অনলাইন থেকে আয় করা যায়? তাহলে আপনি ঠিক জায়গায় এসেছেন। আজকের আর্টিকেলে আমরা গ্রাফিক ডিজাইন নিয়ে ডিটেইলস আলোচনা করব। আশা করছি আপনি এই আর্টিকেল পড়ার আগেই গ্রাফিক ডিজাইনের কথা শুনেছেন অথবা গ্রাফিক ডিজাইন সম্পর্কে কম হলেও জেনেছেন। আপনার এই জানার পরিধিকে পূর্ণতা দিতেই আমাদের আজকের এই লেখাটি।
গ্রাফিক ডিজাইন কি?
আপনার মোবাইল বা কম্পিউটারের ওয়ালপেপার থেকে শুরু করে আপনি এখন যে আর্টিকেলের পেইজটিতে আছেন তার সবই ডিজাইন করেই তৈরি করা হয়েছে। গ্রাফিক ডিজাইন হলো যেকোনো কাল্পনিক ধারনাকে ডিজিটাল ডিভাইস ও সফটওয়ার ব্যবহার করে বাস্তব ভিজ্যুয়াল রূপ দেয়া। সহজভাবে বললে গ্রাফিক ডিজাইন হলো ছবি, টেক্সট, স্লোগান লোগো এগুলোকে এমন নান্দনিকভাবে তৈরি করা যা মানুষকে আকর্ষন করে।
গ্রাফিক ডিজাইনের প্রকারভেদ
সাধারনভাবে গ্রাফিক ডিজাইন ২ রকমের হতে পারে যেমনঃ
১. স্থির গ্রাফিক্স
২. মোশন গ্রাফিক্স
স্থির গ্রাফিকের মধ্যে আবার ৩ টি বিভাগ আছে যেমনঃ
১. ভেক্টর ইমেজ
২. টাইপোগ্রাফি
৩. রাস্টার ইমেজ
মোশন গ্রাফিক্সের ২টি বিভাগ রয়েছে যেমনঃ
১. এনিমেশন( Animation Graphics)
২. ভিডিও গ্রাফিক্স( Video Graphics)
গ্রাফিক ডিজাইনার হতে কি কি স্কিল দরকার হয়?
গ্রাফিক ডিজাইন অনেক বিস্তৃত একটি সেক্টর। আপনি এর কোনো একটি বিভাগে এক্সপার্ট হতে পারলে আপনার আজীবনের জন্যে ইনকামের পথ তৈরি হয়ে যাবে। গ্রাফিক ডিজাইনার হতে গেলে কমন কিছু স্কিলের প্রয়োজন হবে । যার মধ্যে রয়েছে-
১. সৃজনশীল ও মননশীল মানসিকতা।
২. ভালো ড্রয়িং করতে পারা।
৩. সুক্ষ্ম বিষয়কে পরিষ্কার করে গড়ে তোলার সক্ষমতা।
৪. প্রচন্ড্র ধৈর্য যা আপনাকে একজন আন্তর্জাতিক মানের ডিজাইনার হিসেবে গড়ে তুলবে।
৫. সব ধরনের কালার সম্পর্কে ভালো ধারনা রাখা।
৬. একটি লেখা কোন ফরম্যাটে ডিজাইন করা থাকলে তা আকর্ষনীয় হয় তা বুঝতে পারা বা টাইপোগ্রাফি সম্পর্কে ক্লিয়ার ধারনা রাখা।
গ্রাফিক ডিজাইনে প্রয়োজনীয় কিছু টুলস
গ্রাফিক ডিজাইন করার জন্যে সাধারনত কিছু টুলস ব্যবহার করতে হয় যার মধ্যে রয়েছে-
Adobe Photoshop
Adobe Illustrator
Adobe Premier Pro
Adobe Indesign
Adobe After Effects
CorelDraw
GIMP
তবে আপনাকে একজন ডিজাইনার হওয়ার জন্যে এই সবগুলো টুলস ই প্রয়োজন হবে না। শুধু ফটোশপ ও ইলাস্ট্রেটর জানলেই আপনি একজন ভালো ক্রিয়েটিভ ডিজাইনার হতে পারবেন। এই টুলস গুলো পেইড টুলস। তবে এগুলো প্রক্রিয়া করে ফ্রীতে ইউজ করা যায়।
গ্রাফিক ডিজাইন কোথা হতে শিখা যায়
যারা গ্রাফিক ডিজাইন নিয়ে পড়াশুনা করে ডিজাইনার হতে চান, তাদের জন্যে দেশে বেশ কিছু সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে ডিজাইন নিয়ে ব্যাচেলর ডিগ্রী, ডিপ্লোমা করার সুযোগ রয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের অধীনে গ্রাফিক ডিজাইন ডিপার্টমেন্ট রয়েছে। এছাড়া আরো যেসব সরকারী প্রতিষ্ঠানে চারুকলা নিয়ে পড়তে পারবেন তা হলোঃ
জগন্নাথ ইউনিভার্সিটি
জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটি
খুলনা ইউনিভার্সিটি
রাজশাহী ইউনিভার্সিটি
চট্টগ্রাম ইউনিভার্সিটি
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়
এসব প্রতিষ্ঠানে আপনি গ্রাফিক্সে গ্রাজুয়েশন করতে পারবেন। এছাড়া সরকারী গ্রাফিক আর্টস ইনস্টিটিউট থেকে গ্রাফিক ডিজাইনে ৪বছরের ডিপ্লোমা কোর্স রয়েছে। বেসরকারী পর্যায়ে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, শান্ত মারিয়াম ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভ ইত্যাদিতে চারুকলা বা গ্রাফিক ডিজাইনে গ্রাজুয়েশন কোর্স রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে আপনি থিওরি ও প্র্যাক্টিক্যালি দুইভাবেই ডিজাইন শিখতে পারবেন। মূলত এ ধরনের ডিজাইনারদের-ই বেস্ট, মাল্টিট্যালেন্টেড ডিজাইনার বলা হয়। এ ধরনের ডিজাইনারগন বড় বড় মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে উচ্চ বেতনে চাকরি করার সুযোগ পান। আপনার যদি ছোট বেলা থেকেই ডিজাইনা হিসেবে প্রোফেশন বেচে নেয়ার ইচ্ছে থাকে তাহলে এইচ এস সি শেষ করে এই সাব্জেক্টে গ্রাজুয়েশন করতে পারেন।
গ্রাফিক ডিজাইন শেখার জন্যে কোন আইটি প্রতিষ্ঠান বেস্ট
বর্তমানে আমাদের দেশে অনেক আইটি প্রতিষ্ঠানে স্বল্প মেয়াদী গ্রাফিক ডিজাইন কোর্স চালু রয়েছে। তবে এসব আইটি প্রতিষ্ঠানের সবগুলোই অনুমোদিত নয় এবং এদের প্রতিষ্ঠান থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান ও সার্টিফিকেট কোনোটাই যথেষ্ট নয়। আপনি যেহেতু প্রোফেশনালভাবে গ্রাফিক ডিজাইন শিখবেন যাতে এ সেক্টর থেকে ইনকাম করতে পারেন সেজন্যে আপনাকে এক্সপার্ট ডিজাইনার হতে হবে। আর এক্সপার্ট ডিজাইনার হিসেবে আপনাকে গড়ে তুলতে পারে একজন এক্সপার্ট মেন্টর। এখনও বেশ কয়েকটি আইটি প্রতিষ্ঠান সুনামের সাথে বিভিন্ন ফ্রীল্যান্সিং কোর্স করিয়ে যাচ্ছে। এসব কোর্সের মধ্যে গ্রাফিক ডিজাইন পরিচিত একটি কোর্স। বাংলাদেশে পিক্সেন্সি একাডেমি, ক্রিয়েটিভ আইটি ইনস্টিটিউট, ওয়েব কোডার আইটি, বিকেটিটিসি(সরকারি), বিজিটিটিই(সরকারি), কোডারস ট্রাস্ট বাংলাদেশ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানগুলোর কোর্স মানসম্মত। এসব প্রতিষ্ঠান ৬মাস থেকে ১বছর মেয়াদী বিভিন্ন কোর্স করিয়ে থাকে। আপনি গ্রাফিক ডিজাইন শিখার জন্যে এগুলোর কোনো একটি বেচে নিতে পারেন। তবে আপনি যেখান থেকেই শিখেন না কেন আপনার নিজের প্রচেষ্টাই আপনাকে ভালো ডিজাইনার হিসেবে গড়ে তুলবে। শুধু প্রতিষ্ঠান নির্ভর হয়ে ভালো ডিজাইনার হওয়া যাবে না।
অনলাইন গ্রাফিক ডিজাইন কোর্স
বর্তমানে অফলাইনের পাশাপাশি অনলাইন কোর্সের চাহিদা অনেক বেড়েছে। অনলাইন কোর্সের কয়েকটা সুবিধা হলো,
নিজের ইচ্ছেমতো সময় ম্যানেজ করে দেখা যায়।
গুরুত্বপূর্ণ টপিকগুলো পজ করে বারবার দেখার সুযোগ।
অনলাইন কোর্সের ফী তুলনামূলক কম।
এছাড়া ইউটিউব দেখে গ্রাফিক ডিজাইন শিখা যায়। তবে এক্ষেত্রে প্রচুর ধৈর্য থাকতে হবে। আপনি যদি কোনো টাকা খরচ না করে ইউটিউব থেকে দেখে দেখে গ্রাফিক ডিজাইন শিখতে চান, সেক্ষেত্রে আপনি ইংলিশ চ্যানেলগুলো ফলো করতে পারেন। কারন এই চ্যানেলগুলোতে আপনার বেসিক বেশ ভালোভাবে স্ট্রং করে দেয়া হবে। তবে এর জন্যে আপনাকে ভালো ইংরেজি বোঝার ক্ষমতা থাকতে হবে। এছাড়া হিন্দু ও উর্দু ভাষাতেও ভালো ভালো চ্যানেল আছে যেগুলো দেখে শিখতে পারেন।
মনে রাখবেন, ইউটিউব দেখে গ্রাফিক ডিজাইন শিখতে যাওয়াদের বেশির ভাগ-ই মাঝ পথ থেকে ছেড়ে দেয়। কারন এখান থেকে কোনো প্রব্লেম সলভিং কিংবা সাফোর্ট পাওয়া যায় না। তাই সমস্যা থাকলেও আগে একটা পেইড কোর্স করে নেয়া ভালো।
গ্রাফিক ডিজাইন কেন শিখবো
আমাদের দেশে গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করা অনেক বেকার পেলেও, একজন কম শিক্ষিত কিন্তু এক্সপার্ট ডিজাইনার বেকার পাবেন না। বুঝতেই পারছেন ডিজাইন খুবই প্রয়োজনীয় ও উচ্চ অর্থ উপার্জনকারী একটি স্কিল। আপনার কয়টা একাডেমিক সার্টিফিকেট আছে তা বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান দেখে না, দেখে আপনার ডিজাইন কতটা কোয়ালিটিফুল। ডিজাইন যতটা সুক্ষ্ম হবে আপনার ইনকামও সে অনুযায়ী হবে। গ্রাফিক ডিজাইনার হিসেবে কোনো কোম্পানিতে ১৫০০০-২০০০০ বেতনে চাকরি শুরু করা যায়। অভিজ্ঞতা বাড়ার সাথে সাথে দ্রুত ইনক্রিমেন্ট হয়। তবে ডিজাইনারদের ৯-৫টা অফিস ডিউটি না করলেও চলে। কারন তারা চাইলে ঘরে বসেই এক বা একাধিক কোম্পানির সাথে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে। তবে এক্ষেত্রে ভালো নেটওয়ার্কিং থাকতে হয়। শুধু দেশীয় কোম্পানি বাদেও বিদেশি কোম্পানির সাথে কাজ করা যায়। ডিজাইনারদের অসংখ্য কাজ থাকে মার্কেটপ্লেসগুলোতে ।
গ্রাফিক ডিজাইনার হিসেবে কি কি কাজ করা যায়
গ্রাফিক ডিজাইনারগন সাধারনত ২ ধরনের কাজ করেন যেমন ইডিটিং ও ক্রিয়েটিভ ডিজাইন। চলুন দেখে নিই গ্রাফিক ডিজাইনারদের কাজের তালিকা
- লোগো ডিজাইন
- ব্রাউচার ডিজাইন
- লিফলেট ডিজাইন
- প্রোডাক্ট প্যাকেট ডিজাইন
- প্রোডাক্ট ইডিটিং
- বই, এলবামের কভার ডিজাইন
- বিজ্ঞাপনের ব্যানার ডিজাইন
- সোস্যাল মিডিয়া পোস্ট ডিজাইন
- ইনভাইটেশন কার্ড, গ্রিটিং কার্ড ডিজাইন
- টি শার্ট ডিজাইন
- ওয়েবসাইটের পোস্ট ডিজাইন
- ভিডিও এনিমেশন
- ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি
এসব ছাড়াও ডিজাইনারদের কাজের ক্ষেত্র আরো অনেক বিস্তৃত।
গ্রাফিক ডিজাইনারদের আয়ের পরিমান
জুনিয়র ডিজাইনারদের মাসিক ইনকাম ১৫ হাজারের মধ্যে থাকলেও সিনিয়র ডিজাইনারগন মাসে ৩০-৪০হাজারের মতো বেতন পান। তবে এখন শুধু কোম্পানিতে ডিজাইনার হিসেবে কাজ করার জন্যে বসে থাকতে হয় না। ফ্রীল্যান্সিং করে বিশাল অংকের টাকা আয় করা যায়। মার্কেটপ্লেসের কাজগুলোর মধ্যে গ্রাফিক ডিজাইনের চাহিদা অনেক বেশি। ডাটা এন্ট্রি বা লীড জেনারেশনের মতো কাজ গুলো থেকে ডিজাইনারের কাজগুলোতে ইনকাম অনেক বেশি। শুধু ফ্রীল্যান্সিং করে মার্কেটপ্লেস থেকে লক্ষাধিক টাকা আয় করা যায়। এরকম উদাহরন আপনি অনেক পাবেন ইউটিউব অথবা গুগলে। মুক্ত পেশা ফ্রীল্যান্সিং ডিজাইনারদের জন্যে আশীর্বাদ সরূপ।
গ্রাফিক ডিজাইনের ভবিষ্যত
আমরা সবাই মোটামুটি বুঝতে পেরেছি যে সব কিছু দিনে দিনে ডিজিটাল হয়ে যাচ্ছে। মানুষ এখন ব্যস্ত হয়ে পড়েছে অনেক বেশি। তাই তো কেনাকাটার জন্যে মানুষ এখন মার্কেটে না গিয়ে ঘরে বসেই পণ্য বা সেবার অর্ডার করে। আর এ কারনে বাংলাদেশে ইতোমধ্যেই গড়ে উঠেছে বিশাল ই কমার্স ইন্ডাস্ট্রি। সকল ই কমার্স প্রতিষ্ঠানে এক বা একাধিক ডিজাইনারের প্রয়োজন হয়। বাংলাদেশে অনেকগুলো দেশী বিদেশী গ্রাফিক ডিজাইন কোম্পানী রয়েছে যারা শুধু মাত্র গ্রাফিক ডিজাইন সার্ভিস দেয়। এসব প্রতিষ্ঠানের পরিমান দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়া আপনি নিজেও বিভিন্ন সাইটে ডিজাইন সেল করে টাকা আয় করার সুযোগ রয়েছে। আর অসংখ্য কাজের ফ্রীল্যান্সিং মার্কেটপ্লেস তো আছেই। তাই আপনি গ্রাফিক ডিজাইনের ভবিষ্যত নিয়ে শঙ্কিত হওয়ার কোনো কারন নেই। বরং ডিজাইনারদের ভবিষ্যত অনেক উজ্জ্বল।
শেষ কথা
গ্রাফিক ডিজাইন একটি সম্ভাবনাময় খাত। তাই এই সেক্টরে আপনি একটি সিকিউর ক্যারিয়ার পাবেন এটা নিশ্চিত। তবে আমাদের অনেকেই পর্যাপ্ত স্কিল্ড না হয়েই কাজে লেগে যায়, এতে ক্যারিয়ারে এক সময় বিপর্যয় দেখা দেয়। তাই আমাদের পরামর্শ গ্রাফিক ডিজাইন এক্সপার্ট লেভেল পর্যন্ত শিখে এরপর কাজে যোগ দিন। দেখবেন অনেক সিনিয়রকে পেছনে পেলে এগিয়ে যাবেন। আর ইনকাম হবে অনেক বেশি।