আরিফ আজাদের পরিচয় এবং আরিফ আজাদের বইসমূহ

অবিশ্বাসের বিরুদ্ধে ও বিশ্বাসীদের পক্ষে বই লিখে সারাদেশে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন এই সময়ের তরুন লেখক আরিফ আজাদ। ব্যাক্তি আরিফ আজাদ অনেকটাই আড়ালে থাকতে পছন্দ করেন। পত্র-পত্রিকা, টিভি বা সোস্যাল মিডিয়ায় পাওয়া যায় না এই লেখককে। তিনি কেবল ফেইসবুকে তার বিভিন্ন ধ্যান ধারনা, মতামত প্রকাশ করেন। তরুনদের খুব পছন্দের এই লেখক খুবই প্রচার বিমূখ জীবন যাপন করেন। সারাদেশে তার বই সবচেয়ে বেশি বিক্রি ও জনপ্রিয় হয়ে উঠার পরেও তাকে মিডিয়ার সামনে আসতে দেখা যায় না। বিভিন্ন সময়ে তিনি বই মেলাতে আসলেও কারও সাথে ছবি তোলেন না। তার রচিত বইগুলো জনপ্রিয় হওয়ার কারন হলো তিনি ধর্মের পক্ষে লিখেছেন যুক্তি দিয়ে। যেসব যুক্তি সদত্তর দিয়ে খন্ডানো সম্ভব নয়। আরিফ আজাদ ধর্মীয় বিষয়ে লিখলেও তিনি আসলে কোনো ধর্মীয় উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত নন। তিনি জেনারেল লাইনেই পড়াশুনা করেছেন। তবে তার ধর্মীয় অনুভুতি যে অনেক সংবেদনশীল তা তার ফেইসবুকের পোস্ট ও বই এর লেখায় প্রমান পাওয়া যায়।
আরিফ আজাদের পরিচয়
আরিফ আজাদের পরিচয় আসলে বিস্তারিতভাবে বলা সম্ভব নয় । কারন তিনি নিজের সম্পর্কে সব কিছু শেয়ার করতে আগ্রহী নন। তবে মোটামুটি বেসিক ইনফরমেশনগুলো জানা যায় তার সম্পর্কে।
জন্ম
আরিফ আজাদের জন্ম ১৯৯০ সালে। তিনি চট্টগ্রামে জন্ম গ্রহন করেন ও এখানেই বেড়ে উঠেন।
শিক্ষা
আরিফ আজাদ চট্টগ্রাম জিলা স্কুলে পড়াশুনা করেছেন । মাধ্যমিকের গন্ডি ফেরিয়ে ভর্তি হন সরকারী কলেজে। সেখান থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকে ভর্তি হন। তবে তিনি কোন বিষয় নিয়ে পড়াশুনা করেছেন এ বিষয়ে নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।
বৈবাহিক অবস্থা
আরিফ আজাদ বিবাহিত। তিনি পারিবারিকভাবে আয়োজিত বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তিনি এতটাই অন্তর্মূখী যে তার স্ত্রীও জানতেন না যে তিনি এত বড় মাপের লেখক।
সাহিত্যিক জীবন
আরিফ আজাদের বই প্রথম প্রকাশ হয় ২০১৭ সালে। এরপর থেকে তার একে একে কয়েকটি বই প্রকাশিত হয়েছে। বই লেখার পাশাপাশি তিনি কবিতা ও গান লেখেন।
আরিফ আজাদের বই
আরিফ আজাদের বই লেখা শুরু হয় প্যারাডক্সিকাল সাজিদ বইটির মাধ্যমে। এই বইটি ২ কিস্তিতে প্রকাশিত হয়। এরপর একে একে মা,মা,মা, এবং বাবা, বেলা ফুরাবার আগে, আরজ আলী সমীপে, প্রত্যাবর্তন ইত্যাদি। সব বইতেই তিনি তরুনদের মনে উদ্ভুত বিভিন্ন ধর্মীয় প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন যুক্তি ও বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে।
প্যারাডক্সিক্যাল সাজিদ
এই বইটি মূলত বিভিন্ন যুক্তি দিয়ে নাস্তিকদের বিভিন্ন মূল্যবোধকে ভুল প্রমান করা হয়েছে। বইটির ২টি কিস্তি প্রকাশ হয়েছে। যার প্রথমটি প্রকাশিত হয়েছে ২০১৭ সালে দ্য গার্ডিয়ান পাবলিকেশন্স থেকে। এরপর ২০১৯ সালে সমকালীন প্রকাশনী থেকে এর ২য় কিস্তি বের হয়। প্রকাশিত হওয়ার পর এটি সবচেয়ে বেশি বিক্রিত বই এর মর্যাদা পায়। তবে বইটি সরকার কর্তৃক কয়েকবার নিষিদ্ধ করার পর আবারও অনুমতি দেয়া হয়। নিষিদ্ধ হবার কারন উল্লেখ করা এর মধ্যে হোল্ডিং নাম্বার না দেয়া। পরে অবশ্য হোল্ডিং নাম্বার সংযোজন করা হয়।
স্রষ্টাকে নিয়ে সংশয়ে থাকা সাজিদ নামের এক বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুনের সাথে লেখকের যুক্তি তর্কের মাধ্যমে শুরু হয় এই বই এর কাহিনী। সাজিদ এক সময় লেখকের গভীর মননশীল উত্তর ও যুক্তি উপলব্ধি করে পুনরায় স্রষ্টায় বিশ্বাস করে । এরপর সে নিজেই একে একে তার পরিচিত বড় ভাই ও শিক্ষকদের মধ্যে যারা স্রষ্টায় বিশ্বাসী নন কিংবা তাকদীরে বিশ্বাসী নন তাদের সাথে লড়েছেন যুক্তি দিয়ে। চমৎকার সব উপস্থাপনের মাধ্যমে এখানে নাস্তিকদের কড়া জবাব দেয়া হয়েছে। মুক্তচিন্তা করার অধিকার আমাদের দেশে আছে। তবে কিছু দ্বীনি ঘরের সন্তানও কয়টি নাস্তিক্যবাদী বই পড়ে স্রষ্টাকে অস্বীকার করে। এই বইটি একবার পড়লে তাদের মনে ঘুরপাক খাওয়া অনেক প্রশ্নের উত্তর মিলবে। আর তারা ইসলাম থেকে দূরে সরে যেতে চাইবে না। কেউ এই বইটি একবার পড়া শুরু করলে শেষ না করে উঠতে মন চাইবে না।
আরজ আলী সমীপে
আরজ আলী সমীপে বইটি আরিফ আজাদের অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি বই। স্রষ্টাকে নিয়ে ভুল ভ্রান্তি ছাড়ানো ও স্রষ্টার অস্তিত্ব নিয়ে সংশয়ে ঘুরপাক খাওয়া মানুষদের জন্যে এই বইটি খুব কাজের। বর্তমানে মুক্ত জ্ঞান চর্চা নামে যে সরাসরি ইসলামের বিরোধিতা করা হয় যেখানে ইসলামের বিপক্ষে গেলেই সেটার বৈধতা বেড়ে যায় দেশে বিদেশে, বিধর্মীরা তাদেরকে অনেক লোভ লালসা দেখায় আর ইসলামে পক্ষে কথা বললেই মৌলবাদের অভিযোগ দেয়া হয় সেখানে আরিফ আজাদ তার এই বইয়ে যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন স্রষ্টা আছেন, তিনি অবিনশ্বর।
এই বই এর মূল চরিত্র আরজ আলী এক প্রসিদ্ধ নাস্তিক। জ্ঞানপাপী এই নাস্তিক সত্য খুজতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন মিথ্যার, সমাজে ছড়িয়েছেন কলুষতা। ‘সত্যের সন্ধানে’ বই এ যত অসত্য তুলে ধরে স্রষ্টাকে অস্বীকার করেছেন। তীক্ষ্ণ কিন্তু মিথ্যে যুক্তি দিয়ে যুবকদের কিভাবে বিপথগামী করা হয় তার স্বরূপ তুলে ধরা হয়েছে ‘আরজ আলী সমীপে’ বইটিতে।
মা,মা, মা এবং বাবা
পৃথিবীর সবচেয়ে মধুর সম্পর্ক যেখানে তৈরি হয়, কোনো স্বার্থ ছাড়াই যে সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি ত্যাগ থাকে সেটাই সন্তান ও পিতামাতার সম্পর্ক। পিতামাতার গুরুত্ব সন্তানের জীবনে কত বেশি হওয়া উচিৎ তা এই বই পড়লে উপলব্ধি করা যায়। এই বইটি প্রচন্ড রকমের ইমোশনাল একটি বই। অনেক পাঠককেই কাদতে বাধ্য করেছে এই বই। বাবা মার প্রতি হারিয়ে ফেলা ভালোবাসা ফিরে পেতে সাহায্য করেছে বইটি। বইতে এমন কয়েকটি গল্প উল্লেখ করা হয়েছে যেগুলো একজন অবাধ্য সন্তানকেও বাধ্য করতে ও হৃদয়ে ঝড় তুলতে সক্ষম। আধুনিক জীবন যাপনে অভ্যস্ত বর্তমান সময়ের আমরা অনেক বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েছি যেখানে বাবা মা র গুরুত্ব আমাদের কাছে অনেক কমে গিয়েছে। আর এটা হয়েছে বেশিরভাগ উচ্চ শিক্ষিত সন্তানদের মধ্যেই। বইটি পড়লে বিষয়গুলো উপলব্ধি করা যায় আর হৃদয়ে নাড়া দিয়ে উঠে।
প্রত্যাবর্তন
বর্তমান সময়ে অপরাধ করা যেন একটা আনন্দদায়ক কোনো কিছুতে পরিনত হয়েছে যেখানে মানুষ হাসতে হাসতে অন্যায় করে। পৃথিবীটা যেন হয়ে গেছে অপরাধের অনুকূল পরিবেশ । অথচ ইসলামের খিলাফতে সময়গুলোতে সমাজ কাঠামো এমনভাবে তৈরি করা ছিল যেখানে চাইলেও অন্যায় করার সুযোগ ছিল না। আজকের দিনে তরুনরা সপ্তাহে একবার নামাজ পড়ে সেটা অবলীলায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করে আনন্দ পায়। অশ্লীল টিকটক করে বেড়ায়, বেহায়াপনা করে নিজেকে হিরো ভাবে, পর্ণগ্রাফিতে আসক্ত। এ যেন চারিদিকে কেবল অনাচার আর অবিচার। তরুনরা এসবে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়। কারন এ সময়ে তাদের মধ্যে জ্ঞানের পরিপক্কতা থাকে না। ফলে যেকোনো ট্রেন্ডিং এ তারা আসক্ত হয়ে যায়। এ ধরনের সকল বাজে অভ্যাসগুলো থেকে বিরত রাখতে ও অনুশোচনা তৈরি করতে, সঠিক পথের সন্ধান দিতে আলোর বৈঠা নিয়ে এসেছেন লেখক আরিফ আজাদ। তিনি এই বইতে দেখিয়েছেন আমরা কিভাবে অপরাধের বৃত্তে আটকে যাই। কিভাবে আবার সেই বৃত্ত থেকে আমরা মুক্তি পাবো তাও বলা হয়েছে এই বইতে। বইটি তরুনদের জন্যে পথ পদর্শক।
বেলা ফুরাবার আগে পড়লে হয়ত নিজেকেই খুজে আবার।
শেষ বইটি নিয়ে কথা বলব এটা আরিফ আজাদের লেখা খুবই জনপ্রিয় একটি বই। বইটিকে বলা যায় ঝং ধরে যাওয়া বর্তমান তরুন ঈমানকে ধারালো করে তোলার হাতিয়ার। বইটিতে লেখক নিত্য দিনে করা আমাদের ভুল গুলো চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। বর্তমান প্রজন্ম তো জানেই না এক সময় টিভি দেখা পাপ মনে করে ছোটরাও দেখতো না। কারন তারা অবুঝ বয়স থেকে অত্যাধুনিক সব প্রযুক্তির সাথে পরিচিত হয়ে যায়। ভিনদেশী সংস্কৃতি নিজের মধ্যে ধারন করতে গিয়ে ভুলে যায় দায় দায়িত্ব ও নিজ ধর্মীয় নিয়ম নীতি। পাপকে আনন্দ মনে করার স্রোতে গা ভাসিয়ে দেয়া প্রজন্মকে আলোর পথ দেখাতে এই বই যথেষ্ট উপকারী। জীবনে শুধুই আধুনিকতা আর ভোগ বিলাসে মজে থাকতে থাকতে কখন যে মৃত্যুর ফেরেশতা চলে আসে তা আল্লাহ ছাড়া কেউই জানে না। আসলে আমরা অনেক কিছু জেনেও আবার তা ভুলে বসে থাকি চর্চার অভাবে। তবে আমরা ঠিক-ই অন্যায়ের চর্চা অব্যাহত রাখি। এসব বিষয়গুলো উল্লেখ করে লেখক এই বইয়ে বর্তমান সময়ের বিভিন্ন সমস্যাগুলোর পর্যালোচনা করে তা হাদিসের মাধ্যমে সমাধান করার চেষ্টা করেছেন। বইটি সকল মুসলিম তরুনদের পড়া উচিৎ।
আরিফ আজাদ ও তার বই সম্পর্কে বিশিষ্টজনদের উক্তি
ড. আবু বকর মোহম্মদ বলেছেন, আমি আরজ আলী বইটি পড়েছি । এটা আমার কাছে ভালো লেগেছে। এখানে আমাদের দেশের চিচকে নাস্তিকদের প্রশ্নের জবাব দেয়া হয়েছে। নাস্তিকদের শুরুই হয় আরজ আলির মাধ্যমে । তাই বইটি বেশ ভালো। অন্য বই তিনি পড়ার সময় পাননি বলে জানান।
শায়খ মোহম্মদ আহমদ উল্লাহ বলেছেন, সংশয় যখন মুসলিমদের কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে তখন প্যারাডক্সিকাল সাজিদ বইটি অনেক ভাই বোনের ঈমানকে সুদৃঢ় করেছে। এই বই এর লেখক কে একজন মুত্তাকি বলে মনে হয়। এই ধরনের বই আরো আরো আসা উচিৎ।
ড. মিজানুর রহমান আজহারি বলেন, আপনারা যারা তরুন আছেন তাদেরকে আমি প্যারাডক্সিকাল সাজিদ বইটি পড়ার অনুরোধ করছি। এতে নাস্তিক্যবাদের ছড়াছড়িতে থাকা মানুষদের বিপথগামী হওয়া থেকে রক্ষা করবে।
এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর আসিফ নজরুল, ইসলামি সাহিত্যিক ডা. শামসুল আরেফীন আরিফ আজাদের প্রশংসা করেছেন।
আরিফ আজাদের বই বিতর্ক
যারা মূলত মুক্তজ্ঞান চর্চা করে বা নাস্তিক শ্রেনীর তারা কোনোভাবেই আরিফ আজাদকে পছন্দ করবেনা এটা স্বাভাবিক। এদেশে ধর্ম ব্যবসায়ী আছে এ কথা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। আবার এ দেশে নাস্তিকতার চাদর মুড়ি দিয়ে থাকা অনেক এন্টি ইসলামিকও আছেন যাদের শুধু ইসলাম নিয়েই এলার্জি আছে। এরা না আস্তিক না নাস্তিক। এরা ইসলামকে যেহেতু পছন্দ করে না সেহেতু তারা শুধু ইসলামের সমালোচনার করার মাধ্যমে এটা চায় যে অন্যরাও ইসলাম থেকে দূরে থাকুক। তবে গতানুগতিক ধর্মীয় আলেম ওলামাদের বাইরে এমন শক্তিশালী যুক্তি দিয়ে নাস্তিকদের মোকাবেলা করলে তা তরুনদের নিকট অধিক গ্রহনযোগ্য হয়। এজন্যে এমন ব্যক্তিদের অযথা বিতর্কিত করার একটা প্রয়াস হিসেবে ধর্ম ব্যবসায়ী ট্যাগ দেয়া হয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে আরিফ আজাদকে খুবই পছন্দ করি।
পরিশেষে
আরিফ আজাদ এই সময়ের অন্যতম জ্ঞানী ও যুবকদের কর্ণধার ব্যক্তিত্ব আলোর দিশারী। আপনি তাকে বিচার করার আগে তার বইগুলো পড়ুন। আশা করি আপনার পূর্বের ধারনা যেমনই হউক বই পড়ার পর তাকে আর খারাপ মনে হবে না।